বাঁশি কই আগের মতো বাজে না...

আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি

‘আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি’/ বাঁশি কই আগের মতো বাজে না/মন আমার আগের মতো সাজে না/তবে কি ছেলে বেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি...। বাবু গুহঠাকুরতা’র কথায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গানটি গেয়েছেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বাংলাদেশে এ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কনকচাঁপা। এক সময় এ গানটি ছিল খুবই জনপ্রিয়। আর এ গানের মধ্যে বৈশাখী মেলার আবহ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
মেলায় পয়সা-পয়সা দামে তালপাতার বাঁশি কিনে যেভাবে শিশু কিশোরেরা বাজিয়েছেন- যে আনন্দ ছিল, এখন সত্যিকার অর্থে সে আনন্দ আর নেই। সেই তালপাতার বাঁশিও এখন তেমন পাওয়া যায় না। বৈশাখী মেলার ধরনও বদলেছে। গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির স্থানে  প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ অন্যান্য কার্যক্রম। 
পহেলা বৈশাখ, বৈশাখী মেলা বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। আগে দু-তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে, অথবা নদীর ধারে, বটতলায় বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো। এসব মেলায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছে। মেলাজুড়ে কাচের চুড়ি, রঙ-বেরঙের ফিতা, তাঁতের শাড়ি, নকশা করা হাতপাখা, কামার ও কুমোরের দোকান, মুড়ি-মুড়কি-খই, বাতাসা, সন্দেশ, মিষ্টি, মাটির তৈরি খেলনা, পুতুল, ঘুড়ি, নাটাই, গুলতি, অলংকার, তৈজসপত্র, বেলুন, বাঁশি, ফলমূল ইত্যাদির দোকান বসতো।
আর বিনোদনের জন্যে থাকত নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের আসর, কবিগান, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, পুতুল নাচ, নৌকাবাইচ, কুস্তি খেলা ইত্যাদি। কোথাও কোথাও বসতো জুয়ার আসরও! বৈশাখী মেলার শিশু-কিশোরদের প্রধান আকর্ষণ ছিল নাগরদোলা ও বায়োস্কোপ। নাগরদোলার প্রচলন এখনো টিকে থাকলেও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বায়োস্কোপ, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের আসর, কবিগান, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠিখেলা এখন বৈশাখ মেলায় আর দেখা যায় না। 
সে সময় গ্রামের মানুষেরা নতুন দিনের আনন্দে বৈশাখী মেলায় কেনাকাটা করতে যেত। নারীদের জন্যও বৈশাখী মেলা ছিল আনন্দের। বৈশাখী মেলা থেকে গৃহকর্তারা তাদের জন্য শাড়ি, চুড়ি, ফিতা কিনে আনতেন। নতুন খেলনা পেত শিশুরা। আবার কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষদের জন্যও এ মেলা ছিল প্রাণের মেলা। যদিও এর সঙ্গে তাদের জীবন ও জীবিকার তাগিদ তীব্র ছিল।
তাদের হাতের তৈরি তৈজসপত্র বিক্রির উৎসবক্ষেত্রও বৈশাখী মেলা। তাই বৈশাখী মেলা কেবল ঐতিহ্যের মেলাই নয়, এটি অর্থনীতি গতিপথের বিশিষ্ট মাত্রাও বটে। বৈশাখী মেলার মধ্য দিয়ে তাঁতি, কামার, কুমোর, সুতার, হস্ত, কুটির শিল্পীরা অর্থনৈতিক আলোর মুখ দেখে। তাই এ শ্রেণির মানুষদের জন্যও যে বৈশাখী মেলা তাৎপর্যবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গ্রামীণ সমাজ থেকে বৈশাখী মেলা শুরু হলেও বর্তমানে বৈশাখী মেলার উপকরণ ও উদযাপনে ভিন্নতা এসেছে। নাগরিক জীবন পহেলা বৈশাখে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে নতুন মাত্রা যোগ করতে গিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের যাতে বিকৃত উপস্থাপন না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত। বর্তমানে যারা পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবন যাপন করছেন তারা বৈশাখী মেলার প্রকৃত রূপ দেখতে পেয়েছেন। তাদের কাছে বৈশাখী মেলা উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হিসেবে অক্ষত আছে।
গ্রামের গরিব মানুষেরা সারা বছর এই মেলার জন্য অপেক্ষা করতেন। তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল এসব মেলা। গ্রামীণ মেলায় গান-বাজনা তুলনামূলকভাবে কম হতো। গ্রামীণ ও লোকজ সংস্কৃতির প্রদর্শনীর ব্যাপারটাই ছিল প্রধান। তবে বাংলা নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকায় যে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, তার ধরন গ্রামীণ মেলা থেকে অনেকটা ভিন্ন।
ঢাকায় তথা মহানগরীতে যে বৈশাখী উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে লোকজ সংস্কৃতির এবং শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হলেও প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ অন্যান্য কার্যক্রম।’ সিরাজগঞ্জের কিছু কিছু এলাকায় বৈশাখী মেলার নামে মঞ্চ নির্মাণ করে নৃত্যের তালে তালে ড্রাম সেট বাজানো হয়। হস্তশিল্পের কিছু দোকান বসলেও ক্রেতা আকর্ষণের মতো মালামাল খুব একটা চোখে পড়ে না। নাগরদোলা ও চড়কি শিশুদের বিনোদনের প্রধান আকর্ষণ।
দিন শেষে বিকালে মেলা থেকে ছেলেমেয়েদের দল বেঁধে বাড়ি ফেরা, মেলা থেকে কেনা বাঁশি বাজানোর হিড়িক। শুধু কি তাই? মাটির তৈজসপত্র, ব্যাংক, প্লাস্টিকের গাড়ি, খেলনা কত কিছু কিনে ফিরত সবাই! অনেকের এখনো মাটির ব্যাংকের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। মেলায় গিয়ে বৈশাখে নতুন ব্যাংক কেনা হতো আর তাতে বছরজুড়ে জমানো টাকা এক সময় ভেঙে নিজের হিসাবে জমা হতো বললেন ষাটোর্ধ্ব অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আফজাল হোসেন।
তিনি বললেন, ঐ সময়ে কেনা একটা ব্যাংক যার আকৃতি অনেকটা কাঁঠালের মতো। আরেকটা বিষয় ভুলবার নয়। প্লাস্টিকের খেলনা মোবাইল! যাতে বিভিন্ন টিউন সেট করা থাকতো, বিশেষ কিরে ‘মেলায় যাই রে’ বাজানোর মাধ্যমেই যেন ছেলেবেলায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতাম।
এসব মেলায় বাতাসা, জিলাপি, মুড়িসহ নানা খাবার সামগ্রীও পাওয়া যেত। এমনকি আমাদের গ্রামাঞ্চলের মেলায় দেখা যেত মৌসুমি ফলমূল, তরিতরকারি, তাজা মাছ নিয়েও বিক্রেতারা পসরা সাজাতো।
কিন্তু বাংলা তারিখের ব্যবহার কম থাকায় বাংলা দিনপঞ্জিকার হিসাব ভুলতে বসেছি আমরা নবীন প্রজন্ম। ব্যবহার কম করায় অনেকের কাছে বাংলা মাসের তারিখ মনে রাখাই কঠিন হয়ে যায়। হুট করে প্রয়োজন হলে চোখ বুলিয়ে নেই দৈনিক পত্রিকার পাতায় কিংবা সহযোগিতা নেই গুগলের। আমাদের এই নবীন প্রজন্মের মাঝে বাংলা তারিখ ব্যবহারের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করানো জরুরি।
শুধু বিশেষ দিনের বাংলা তারিখ না জেনে প্রতিটি দিনের চর্চা হোক প্রচলিত তারিখ গণনার পাশাপাশি বাংলা দিনপঞ্জিকার মতো। সবশেষে প্রত্যাশা-পুরনো সব ভুলে সম্ভাবনায় নতুন উচ্ছ্বাসে শুরু হোক নববর্ষ। সুখ ও সমৃদ্ধিতে কাটুক প্রতিটি বাঙালির পুরো বছর।

বিজ্ঞাপন