পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলের খামার ও কৃষিতে নিঃস্ব মানুষের ভাগ্যবদল

পাবনা-সিরাজগঞ্জের পদ্মা-যমুনার বিস্তীর্ণ বালুচরে নীরব কৃষি বিপ্লব ঘটেছে। আর এ বিপ্লবের মূল সারথি হচ্ছে নদীভাঙা মানুষ। এক সময় নদীই যাদের ভূমিহীন সর্বহারা করেছে, এখন সে নদীর চরই তাদের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। নদীভাঙ্গা ভূমিহারা মানুষ আজ চরে ফলাচ্ছেন বাদাম, সরিষা, শাক-সবজি, কালাই, তিল, কলা ও থাই কুলসহ বিভিন্ন অর্থকরী ফসল। এ ছাড়া চরে ছোট ছোট অসংখ্য গরু ও মহিষের খামার গড়ে উঠেছে। আর খামারের দুধ ও কৃষিজপণ্য বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য।
 
পাবনার সদর, ঈশ্বরদী, সুজানগর, বেড়া উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জের সদর, কাজিপুর, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলায় যমুনা ও পদ্মায় জেগে ওঠা চরে নদীভাঙা শত শত মানুষ শুধু কৃষিজপণ্য উৎপাদনই করছেন না, তারা ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তুলেছেন গরু ও মহিষের খামার। খামারগুলোতে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ লিটার খাঁটি দুধ। এ দুধ চরবাসীর চাহিদা মিটিয়ে জেলা ও উপজেলার হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে। গত এক যুগে গো-মহিষের খামার ও দুগ্ধ শিল্প নদীভাঙা মানুষের জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক চালচিত্র বদলে দিয়েছে।
নদীভাঙনে বাস্তহারা নিঃস্ব শত শত পরিবার পাবনার বেড়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, সদর উপজেলা, চৌহালী, শাহজাদপুর উপজেলার পদ্মা-যমুনা বুকে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়ে তোলে। তাদেরই একজন আলম প্রামাণিক বেড়া উপজেলার চরনাকালিয়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। ১৮ বছর আগে অন্যের জমিতে কামলা খেটে ও বর্গাচাষি হিসেবে কাজ করে এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা থাকতে হতো উপোস। আর আজ তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৫ লাখ টাকা।
বন্যা আর নদীভাঙনের সাথে যুদ্ধ করতে হয় বলে অর্থনৈতিক দুর্দশা চরবাসীদের স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু এখন ব্যাপক লাভের মুখ দেখে চরবাসীরা যেভাবে গরু পালনে ঝুঁকছেন তাতে শিগগিরই গরু পালনই চরবাসীর প্রধান পেশা হয়ে দাঁড়াবে বলে অনেকের ধারণা।
 
যমুনা নদীপাড়ের নাকালিয়া বাজারটি বেড়া, চৌহালী, শাহজাদপুর ও শিবালয় উপজেলার অন্তত ৫০টি চরের বাসিন্দাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এ বাজারের ঘাটে কথা হচ্ছিল চরনাগদা গ্রামের বাসিন্দা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঈসমাইল মোল্লার সাথে। তার মতে ১৫ বছর আগে হাতে গোণা কিছু গৃহস্থ উন্নত জাতের গাভী, আবার কেউ ষাঁড় বাছুর এনে পালন করতে থাকেন। এর দুধ থেকে ভালো আয় আর গরু মোটাতাজা করার করণে ব্যাপক লাভ হওয়ায় গরু পালনে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। তিনি আরো বলেন, চরে গরু পালন ১৫ বছর আগে শুরু হলেও বছর চারেক ধরে এ বিপ্লব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে চরের অন্তত ৯০ ভাগ মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে।
 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে দেশের প্রধান দুগ্ধ উৎপাদনকারী ও গরু পালনকারী এলাকা গড়ে উঠেছে। তবে গরুর খামার ও গরু পালনকারীর সংখ্যা চর এলাকায় এত ব্যাপকহারে বেড়ে চলছে যে তা রীতিমত বিস্ময়কর। পাবনা-সিরাজগঞ্জের কয়েক উপজেলা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ, ফার্মফ্রেসসহ প্রায় ২০টি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বাজারজাত করে আসছে। এ দুধের অন্তত ৬০ হাজার লিটারই চরের বলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় ও কয়েকটি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে।
 
বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গরু পালন করে চরের মানুষ গত এক যুগে যে সাফল্য পেয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। বেড়ার চরগুলোর মধ্যে চরনাকালিয়া, চরনাগদা, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা, মিনারদিয়া, ওমরপুরসহ কয়েকটি চরে বলা চলে গরু-মহিষ পালনে বিপ্লব ঘটে গেছে।
 
যমুনা নদীপাড়ের নাটুয়ারপাড়ায় ৬ টি ইউনিয়নের 
অন্তত ৩০টি চরের বাসিন্দাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। 
নাটুয়ারপাড়া নৌকা ঘাটে কথা হচ্ছিল নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুর রহিম সরকারের সাথে। তার মতে ১০/১২ বছর আগে হাতে গোণা কিছু গৃহস্থ উন্নত জাতের গাভী, আবার কেউ ষাঁড় বাছুর এনে পালন করতে থাকেন। এর দুধ থেকে ভালো আয় আর গরু মোটাতাজা করে এখন অনেকেই লাভবান হচ্ছেন।
 
কাজিপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, চরগিরিশ, তেকানী, মনসুর নগর, খাসরাজবাড়ী, নিশ্চিন্তপুর, শুভগাছা ও মাইজবাড়ী ইউনিয়নের দুর্গম চর এলাকার শত শত মানুষ গরু ছাগল পালন এখন সাফল্য পেয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। চরে নাটুয়ারপাড়ায় প্রতি শনিবার ও বুধবারের বিশাল গরু ছাগলের হাট বসে। বেচাকেনা হয় প্রচুর।
বিজ্ঞাপন