ঈদ আনন্দে মহাস্থানে দর্শনার্থীর ভীড়

তীব্র গরমে শুরুতে  প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী আড়াই হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস পুণ্ড্রনগর বগুড়ার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র মহাস্থানগড়ে তেমন মানুষের আনাগোনা দেখা না গেলেও আকাশ মেঘলা হওয়াতে একটু গড়মের তীব্রতা কমেছে।  গড়মের তীব্রতা কমার সাথে সাথে প্রাচীণ পুরাকীর্তি এবং প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনে ঠাসা  স্থানটিতে উপচে পড়া মানুষের ভীড় জমেছে।  পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে স্থানীয় ও দেশী বিদেশী পর্যটকদের কৌতুহলটা অন্যরকম। প্রতি বছরে ঈদ এলে মহাস্থানগড় দর্শনার্থীদের ভীড়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে যায়। চলতি ঈদেও শুরুতে তেমন না হলেও এখন ব্যত্যয় ঘটেনি।  দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জোরদার ব্যবস্থা নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
যেভাবে যাওয়া যাবে মহাস্থানগড়েঃ মহাস্থানগড় বগুড়া শহর ১২ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মহাস্থানগড়ে যেতে হলে শহরের সাতমাথা থেকে পায়ে চালিত রিকশা অথবা অটো রিকশায় যেতে হবে দত্তবাড়ীতে। এখানে পৌছতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৭ মিনিট।  এরপর দত্তবাড়ী থেকে থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে ২০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি পৌছে যেতে পারবেন মহাস্থান শাহ সুলতান বলখীর মাজারের দরজা পর্যন্ত। কেউ যদি সিএনজি অটোরিকশাকে ঝুকি মনে করে বাসে মহাস্থান যেতে চান তাহলে তাকে দত্তবাড়ী থেকে মাটিডালি যেতে হবে। মাটিডালি থেকে পর্যাপ্ত বাস পাওয়া যাবে মহাস্থান যাওয়ার জন্য।
মহাস্থানে ঘুরতে আসা আকলিমা খাতুন বলেন, নন্দীগ্রাম কাহালু থেকে এখানে ঘুড়তে আসছি। সব সময় আসা হয়না। এই ঈদের সময় একটু সময় পাওয়া যায় বান্ধবীদের সাথে। তবে বগুড়া শহরে দেখার মতো সবচেয়ে পুরাতন ঐতিহ্য স্থান এটি। যে কারণে আজকে বান্ধবীদের নিয়ে মহাস্থানে ঘুরতে এসেছি। খুব ভালো লাগছে।
আরেক দর্শনার্থী আহসান হাবীব বলেন, আমরা নওগাঁ থেকে মহাস্থানে ঘুরতে আসছি। তিনি এর আগেও এসেছেন। কিন্তু পরিবার নিয়ে এবারই প্রথম। ব্যস্ততার কারণ পরিবারকে সময় দেয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। ঈদে ছুটিতে তাই তিনি পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। মহাস্থানে এসে খুব ভালো লেগেছে। আমরা ছবি তুলছি এগুলো ফেসবুকে পোস্ট করবো।
সাফিয়া জান্নাত নামে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বলেন, আমি ভাইয়াদের সাথে ঘুরতে এসেছি। এর আগে গাড়ীতে করে বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছি। জাদুঘরে ঢুকেছিলাম। পুরনো অনেক জিনিসপত্র দেখলাম। এছাড়া গোবিন্দ ভিটায় গিয়েছিলাম। সেখানে অনেকগুলো ছবি উঠিয়েছি।  
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান রাজিয়া সুলতানা জানান,  তীব্র গরমে ঈদের দিন মানুষের ভীর কম ছিল। তবে একটু আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়াতে দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভীর হয়েছে। এছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমরা থানাকে জানিয়েছি। সেখান থেকে তারা হেল্প করছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ আমাদের হেল্প করছে। এছাড়া আমাদের ২০ জন ব্যাটালিয়ন আনসার আছে। সবমিলিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা আছে।
মহাস্থানের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এটি তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মৌর্য, সুঙ্গ, গুপ্ত, পাল, সেন প্রভৃতি বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজবংশের রাজত্বের রাজধানী ও শাসনকেন্দ্র ছিল। আর এ কারণেই পুরো মহাস্থানগড় একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। আড়াই হাজার বছরের সভ্যতা নিয়ে মাটির নিচে চাপা পড়া এই নগরীটি প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ও এক কিলোমিটার প্রশস্ত । তবে এই এলাকাটি সমতলভূমির তুলনায় অনেক উচু। মাটির নিচে চাপা পড়ার কারণেই এই অবস্থা। তবে নগরীটি মাটির নিচে চাপা পড়লেও এর দুর্গপ্রাচীর আর প্রবেশদ্বারের ধ্বংসাবশেষ এখনো দৃশ্যমান। পাঁচ হাজার ফুট দীর্ঘ প্রাচীরবেষ্টিত ও চার হাজার ৫০০ ফুট প্রশস্ত নগরীর পুরোটাই প্রত্মতাত্ত্বিক নির্দশনে সমৃদ্ধ। প্রতিনিয়ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বিভিন্ন নিদর্শন বেরিয়ে আসছে নগরীটিতে। বিভিন্ন সময় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বিভিন্ন আমলের নির্মাণ স্তরের স্থাপত্য কাঠামোর পাশাপাশি বেশ কিছু প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়। এই প্রত্নসামগ্রীগুলো মহাস্থান জাদুঘরে রাখা আছে। জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে উত্তরাঞ্চলীয় কালো চকচকে মৃৎপাত্রের টুকরো, সুঙ্গ আমলের পোড়ামাটির কারুকার্যখচিত ফলক, সাঁচে ঢালাইকৃত মুদ্রা, গুপ্ত আমলের পোড়ামাটির মাথা, ভাসুবিহার থেকে প্রাপ্ত পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকের পোড়ামাটির ফলক, অষ্টম ও নবম খ্রিস্টাব্দের মূল্যবান পাথরের বটিকা, বেলে পাথরের বুদ্ধমূর্তি, বেলে পাথরের নকশাকৃত পিলার, পোড়ামাটির পাত্র, নবম ও দশম খ্রিস্টাব্দের বিষ্ণুমূর্তি, অবলিকেতেশ্বর মূর্তি, দত্তাত্রেয় মূর্তি, দশম ও একাদশ খ্রিস্টাব্দের বিষ্ণুমূর্তি, চামর ধারিণী, উমামহেশ্বর, সূর্যমূর্তি, লক্ষ্মী-কার্তিকসহ বিভিন্ন মূর্তি, দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দের সংস্কৃত ভাষার শিলালিপি, পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের (মুসলিম আমল) শিলালিপি, অলংকৃত ইট, চকচকে পাত্র ইত্যাদি। মহাস্থানগড়ের এই জায়গার মধ্যে রয়েছে মহাস্থান মাজার, পরশুরাম প্যালেস, জিয়ৎ কুণ্ড, গোবিন্দ ভিটা, বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুণ্ডু, মুনির ঘোন ও শিলা দেবীর ঘাট, জাদুঘর। নগরীর বাইরের প্রায় পাঁচ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে রয়েছে বেহুলার বাসরঘর। এটি গোকুল মেধ নামেও পরিচিত। এছাড়া ভীমের জাঙ্গাল, ভাসুবিহার, বিহার ধাপসহ নানা প্রত্নস্থল ও নিদর্শন রয়েছে সেখানে।

 

বিজ্ঞাপন