দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তেজনা কি সংঘাতে গড়াবে?

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ এখন দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক কত দ্রুত চূড়ান্ত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায়, সেই আশঙ্কায় খুবই উদ্বেগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। পরিস্থিতি যে খারাপ হতে পারে, তার অনেক আলামতই আছে, কিন্তু আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় খুব কম। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীনের সঙ্গে আধুনিক সম্পর্ক স্থাপনের পর বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কর্তৃত্ববাদ ও উদার গণতন্ত্র—এই দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা—দুই দেশের সম্পর্ককে নির্ধারণের মূল মাপকাঠি। বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে এই সাংঘর্ষিক মতাদর্শ দুঃখজনকভাবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে, তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিমে চীন তাদের সামরিক তৎপরতা (বিশেষ করে বিমানবাহিনীর উপস্থিতি) বাড়ানোর ঘটনাটি। চীনের যুদ্ধবিমান যেখানে উড়েছে, সেটিকে তাইপে সরকার নিজেদের আকাশসীমা বলে দাবি করে। তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় চীনের এই পদক্ষেপ। চীন ও তাইওয়ানের মধ্য যদি সংঘাত লেগে যায়, তবে প্রথমেই প্রাতাস নামক জায়গায় তাইওয়ানের সামরিক ছাউনি আক্রান্ত হতে পারে। যদিও চীনের পক্ষ থেকে যে নিষেধরেখা এঁকে দেওয়া আছে, তাইওয়ানের নেতারা সেটা অতিক্রম করে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই চীনের পক্ষ থেকে সামরিক পদক্ষেপ আসতে পারে। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যকার এ সামরিক সংঘাত দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি ডেকে আনবে। সে ক্ষেত্রে সংঘাত নিশ্চিতভাবেই বড় পরিসরে ছড়িয়ে যাবে।

কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র (এর মিত্ররাও) উপলব্ধি করতে পারছে, তাদের সম্পর্ক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো অনেক কারণই রয়েছে। আমাদের সর্বোত্তম আশা হচ্ছে, দক্ষিণ-চীন সাগরে নড়বড়ে হলেও যে স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে, সেটা যেন অব্যাহত থাকে। দক্ষিণ চীন সাগরে কার কতটা সীমা এবং সামুদ্রিক সম্পদের কার কতটা মালিকানা, তা নিয়েও সংঘাত বেধে যেতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কাছে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তাদের দাবি করা সম্পদ ফিরিয়ে দেবে। ওয়াশিংটন মনে করে বেইজিং দক্ষিণ চীন সাগরে ‘গুন্ডামি’ করছে। অন্যদিকে চীনও কোনো ধরনের ছাড় দিতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র এখন মৌখিকভাবে চীনের কর্মকাণ্ডের ‘শিকার’ দেশগুলোকে মৌখিক সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এতে তারা সাময়িক সময়ের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারছে। কিন্তু সেটা কত দিন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কেননা বন্ধু ও মিত্ররাষ্ট্রগুলোকে বাস্তবে সামরিক সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাওয়া ওয়াশিংটনের জন্য কঠিন।

দৃষ্টান্ত হিসেবে, পঞ্চাশের দশকে ফিলিপাইন ও চীনের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যায়। ফিলিপাইনের সঙ্গে ১৯৫১ সালে সম্পাদিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আলোকে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনকে সামরিক সহযোগিতা দিয়েছিল। এতে ওই অঞ্চলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে একই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির উপক্রম হয়েছিল। মালয়েশিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাছে একটি তেল খনন জাহাজকে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। কাছাকাছি অবস্থান করছিল চীন সরকারের একটি জরিপ জাহাজ, সেটি ঘিরে পাহারায় ছিল বেশ কয়েকটি কোস্টগার্ড জাহাজ। ফলে উত্তেজনা চরমে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের কমান্ডার তাঁদের কাজের ন্যায্যতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওপর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গুন্ডামি অবশ্যই বন্ধ হতে হবে।’ গত ৫ জুন অস্ট্রেলিয়া ও চীনের যুদ্ধবিমান দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। এ ঘটনায় অস্ট্রেলিয়া ও চীন একে অন্যকে দায়ী করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার মূল সমস্যা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তাদের সমকক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ইনস্টিটিউট অব চায়না–আমেরিকা স্টাডিজের চেয়ারম্যান সৌরভ গুপ্ত যেমনটা বলেছেন, ‘দুই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার এই মতপার্থক্য শ্বেতাঙ্গ জাতিবাদের মতোই একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে।’

বিজ্ঞাপন

কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র (এর মিত্ররাও) উপলব্ধি করতে পারছে, তাদের সম্পর্ক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো অনেক কারণই রয়েছে। আমাদের সর্বোত্তম আশা হচ্ছে, দক্ষিণ-চীন সাগরে নড়বড়ে হলেও যে স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে, সেটা যেন অব্যাহত থাকে। এই ভঙ্গুরতা পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, উভয় দেশকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে ‘শক্ত দেয়াল’ ও ‘প্রতিরক্ষা রেলিং’ নির্মাণ করতে হবে, যাতে বড় পরিসরে সংঘাত ছড়িয়ে না পড়ে। সময় যতো যাচ্ছে, উত্তেজনা ততটা বেড়েই চলেছে। একদিকে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে মিটমাট করা কিংবা সহ-অবস্থানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অনীহা, পুরো অঞ্চলকে ধীরে ধীরে একটা রণক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে দিতে পারে। তাতে নিশ্চিতভাবেই মানবতার পরাজয় হবে। দক্ষিণ চীন সাগরে সেই মানবিক বিপর্যয় কি আমরা ঘটতে দেব?

 

বিজ্ঞাপন