বগুড়ার শেরপুরে পানি শূণ্য করতোয়া নদী

এক সময়ের প্রমত্ত করতোয়া ঢেউয়ের পরে ঢেউ তুলে চলাচল করতো বড় বড় বজরা নৌকা। কালের আবর্তে সব বন্ধ হয়ে গেছে। সেই নদী শক্তি ও জৌলুস হারিয়ে এখন ক্ষীণকায়া। এখন নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। নদী সংলগ্ন গ্রামগুলো এক সময় নদী ছিল। এপার-ওপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার সবই গড়ে উঠেছে মজে যাওয়া করতোয়ার ওপরেই। নদী যখন নাব্য ও প্রশস্ত ছিল, তখন নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট ছোট নৌকা অথবা ভেলা। করতোয়ার সুস্বাদু মাছের সুখ্যাতি আছে। করতোয়ার পানিতে মলা, ঢেপা, চ্যালা, খলসা, বাইম, বাতাসি, বাইল্যা, টেংরা, পোয়া, মলা, কাকিলা, চাঁদা, ছাট চিংড়ি, দেশী জাতের শিং, কৈ শোল ও বোয়ালসহ ৪০-৫০ প্রজাতির মাছে ভরপুর ছিল নদী। স্থানীয় অধিবাসীরা মাছের জন্য নদী-নির্ভর ছিল। জেলেরা এই নদীর মাছ শিকার করেই জীবন যাপন করত। এখন হারিয়ে গেছে সব।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শেষ সীমানা পর্যন্ত করতোয়া নদীর পরিধি ১২৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে শহরের ১৩ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে করতোয়া নদী।
সরে জমিনে গিয়ে দেখা যায়, শেরপুর উপজেলার মির্জপুর ইউয়িনের ব্রিজের কাছে করতোয়া তীরে এসে এমন অবস্থা চোখে পড়ে। নদীর তলদেশে এক ফোঁটাও পানি নেই। এক পাড়ে ইরির আবাদ অন্য পাশে জয়লা আবর্জনায় ও স্থাপনা করে হচ্ছে দখল। দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এখানে এক সময়ের বড় কোনো নদী ছিল। এ নদীর ওপর ব্রিজটি এক পারে মির্জাপুর ইউনিয়ন ও অন্য পারে খানপুর ইউনিয়নের সীমানা নির্ধারক। 
নুরুল ইসলাম জানান, করতোয়ার বুকে মাছ শিকার করে একসময় জীবিকা নির্বাহ করত পাড়ের হাজারও পরিবার। পানি শুন্য হওয়ায় এসব পরিবারও এক সময় অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখন বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িয়ে পড়ছে তারা। আবর্জনা ভরাট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী অন্যদিকে আবর্জনার দুর্গন্ধে ঐ এলাকার বসবাসকারী মানুষদের সেখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উজান থেকে পানির প্রবাহ নেই। দখল আর দূষণে এ নদী জর্জরিত। 
আবু বকর মন্ডল লাল মিয়ার অভিজ্ঞতায় এখনো আছে স্রোতস্বিনী করতোয়ার স্মৃতি। আবু বকর লাল মিয়া বিজয় বাংলাকে জানান, “জনশ্রুতি আছে যে করতোয়ার পাশে শেরপুর হাটে সওদাগরী জাহাজ, লঞ্চ এবং বড় বড় নৌকা বজরা যেটা বলে সেটা যাতায়াত করতো। পণ্য পরিবহন হতো এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল শেরপুর। এবং করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছে।”
“তিনি আরো জানান, এই করতোয়া নদীর ধারে শেরপুর হাট হওয়ায়  নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, কাহালু, বগুড়া সদর দক্ষিনের ধান, চাল, গম বিক্রয়ের একমাত্র হাটছিল শেরপুরের হাট। তারা এক যোগে ৫ থেকে ৮টি করে গরু, মহিষের গাড়ি নিয়ে আসত যেন ডাকাত না ধরে। গরুর গাড়ীতে ৮ থেকে ১০ মন ও মহিষের গাড়িতে ১৪ থেকে ১৮মন পর্যন্ত ধান অথবা চাল নিয়ে রাত্রি ১০টায় রওনা হত ভোরে শেরপুর হাটে পৌছাত। করতোয়া নদীর ঘাটের কারণে এই হাটে দুর দুরান্ত থেকে ধান,চাল ক্রয়ের জন্য ব্যাপারিরা লঞ্চ, নৌকা, জাহান নিয়ে আসত। এই করতোয়া নদী সবসময় পানির কলোতানা ছিল, ঘাট ছিল, পানির সবসময় স্রোত চলিছে। এখন নদীর অনেকটা দখল হয়ে গেছে, আমরা যা দেখিছি তার চেয়ে এপাড়ে ওপারে দখল হইচ্ছে। আর আবর্জনাতো আছেই।” করতোয়া নদীটি এখন পানি শুন্য হয়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় পানির প্রবাহ পুকুরের মত আবার কিছু জায়গায় জীর্ণ নালার মতো।  আর নদীর বুকে অনেক জায়গায় দেখা যায় ধার ভুট্রা, শরিষাসহ বিভিন্ন চাষাবাদও হচ্ছে।
এ বিষয়ে বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, নদীতে অবৈধ দখলকারীদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগ নিচ্ছেনা এমন অভিযোগ সঠিক নয়। তালিকা অনুযায়ী বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। নদীর জায়গা যদি কেউ দখল করে থাকে তবে আমরা সেটিকে উচ্ছেদ করবো।
 

বিজ্ঞাপন